স্বাধীনতার যাত্রাপথে বিপ্লবীদের কাহিনি: ভারতের সংগ্রামী নেতাদের অবদান।

Indian freedom fighters in Bengali

 ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন ছিল এক দীর্ঘ ও ত্যাগে ভরা সংগ্রাম, যেখানে বিভিন্ন সমাজ, ভাষা ও মতের মানুষ একত্রিত হয়ে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে লড়াই করেন। এই আন্দোলনের পেছনে যাঁরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন: বিপিনচন্দ্র পাল, যিনি চরমপন্থী জাতীয়তাবাদের প্রবক্তা; চন্দ্রশেখর আজাদ, অদম্য সাহসী বিপ্লবী; চক্রবর্তী রাজা গোপালাচারী, যিনি অহিংস আন্দোলনের পাশাপাশি প্রশাসনিক নেতৃত্ব দেন; চিত্তরঞ্জন দাস, কংগ্রেসের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা; দাদাভাই নৌরজি, drain theory-র মাধ্যমে ব্রিটিশ শোষণের স্বরূপ উন্মোচনকারী; ডঃ ভীমরাও আম্বেদকর, সংবিধানের রচয়িতা ও সমাজ সংস্কারক; বাল গঙ্গাধর তিলক, ‘স্বরাজ আমার জন্মসিদ্ধ অধিকার’ এই ডাকের মধ্য দিয়ে জাতীয়তাবাদ জাগান; লালা লাজপত রায়, ‘পাঞ্জাব কেশরী’ নামে পরিচিত যাঁর নেতৃত্ব ছিল বলিষ্ঠ; অরবিন্দ ঘোষ, যিনি আধ্যাত্মিক চিন্তাধারায় জাতীয়তাবাদ মিশিয়েছিলেন; এবং খান আব্দুল গফফর খান, যিনি অহিংস পথেই সংগ্রাম চালিয়েছেন। তাঁদের প্রত্যেকের অবদান ভারতের ইতিহাসে অমর হয়ে আছে। এই ব্লগে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হয়েছে তাঁদের জীবন, আদর্শ ও স্বাধীনতা সংগ্রামে অবদান নিয়ে।

ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে বিপিনচন্দ্র পাল, চন্দ্রশেখর আজাদ, চক্রবর্তী রাজা গোপালাচারী, চিত্তরঞ্জন দাস, দাদাভাই নৌরজি, ডঃ ভীমরাও আম্বেদকর, বাল গঙ্গাধর তিলক, লালা লাজপত রায়, অরবিন্দ ঘোষ এবং খান আব্দুল গফফর খানের অবদান ছিল অনস্বীকার্য। এই ব্লগে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে তাঁদের জীবন, আদর্শ, এবং ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে তাঁদের কার্যকলাপ ও অবদান সম্পর্কে।

table of content (toc)

বিপিনচন্দ্র পাল (১৮৫৮-১৯৩২)

  • 'Father of the Revolutionary Thought in India' নামে পরিচিত।
  • 'পরিদর্শক' নামক সাপ্তাহিক পত্রিকা শুরু করেন এবং 'New India' নামক পত্রিকা শুরু করেন। 
  • প্রথমে নরমপন্থী জাতীয়তাবাদী থাকলেও পরে স্বরাজ ও স্বদেশি আন্দোলনে যোগদান করেন।
  • ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দে অরবিন্দ ঘোষের সঙ্গে 'বন্দেমাতরম' -এর সম্পাদনা করেন।

দাদাভাই নৌরজি (১৮২৫-১৯১৭)

  • ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দে জাতীয় কংগ্রেসের কলকাতা অধিবেশনে প্রথম স্বরাজের দাবি উত্থাপন করেন।
  • তিনি প্রথম ভারতীয় তথা এশীয় হিসেবে যিনি 'House of Commance' -এর সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হন ১৮৯২ সালে।
  • তিনি তাঁর 'Poverty & Un-British Rule in India' (১৯০১) গ্রন্থে ভারত থেকে সম্পদের বহির্গমন তত্ত্বের কথা বলেন।
  • তিনি 'Indian Gladstone', 'Grand old man of India' প্রভৃতি উপাধি পান।
  • ভারতে গ্র্যান্ড ওল্ড ম্যান হিসাবে, সুপরিচিত।
  • 'Poverty and  Rule in India' -বইয়ের লেখক।
  • ১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দে জাতীয় আয়ের প্রথম হিসাব পেশ করেন।
  • ১৮৮৬, ১৮৯৩ এবং ১৯০৬ তিনবার ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি হিসেবে নির্বাচিত হন।।
  • ১৮৮৩ সালে দৈনিক পত্রিকা 'Voice of India' প্রকাশ করেন।
  • 'Gyan Prasarak Mandali'-এর প্রতিষ্ঠাতা। এই সংস্থাটি বয়স্কদের মধ্যে শিক্ষার বিস্তার করা।

ডঃ ভীমরাও রামজী আম্বেদকর (১৮৯১-১৯৫৬)

  • নিম্নশ্রেণির মানুষের নেতা ছিলেন।
  • তিনি Depressed Classes Institution (১৯২৪) এবং সমাজ সামন্ত সংঘ (১৯২৭) প্রতিষ্ঠা করেন।
  • তিনটি গোলটেবিল বৈঠকেই তিনি অংশগ্রহণ করেন এবং গান্ধীজির সঙ্গে পুনা চুক্তি স্বাক্ষর করেন (১৯৩২)।
  • তিনি গভর্নর জেনারেলের Executive Council-এর সদস্য ছিলেন এবং 'Indian Labour Party' 'Scheduled Caste Federation' গঠন করেন।
  • তিনি ভারতীয় সংবিধানের 'Drafting Committee'-র সদস্য ছিলেন।
  • স্বাধীন ভারতের প্রথম আইনমন্ত্রী হিসেবে 'Hindu Code Bill'-এর প্রস্তাবনা করেন।
  • ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দে তিনি 'Republican Party' তৈরি করেন।

বাল গঙ্গাধর তিলক (১৮৫৬-১৯২০)

  • পুনার চিৎপাবন ব্রাহ্মণ পরিবারের সন্তান, চরমপন্থী রাজনীতিবিদ।
  • ১৮৮০ খ্রিস্টাব্দে 'পুনা নিউ ইংলিশ স্কুল', ১৮৮৪ খ্রিস্টাব্দে 'ডেকান এডুকেশন সোসাইটি', ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দে 'ফার্গুসন কলেজ' প্রতিষ্ঠা করেন।
  • তিনি মারাঠি ভাষায় 'কেশরী' ও ইংরেজি ভাষায় 'মারহাট্টা' নামক পত্রিকা প্রকাশ করেন।
  • তিনি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করার উদ্দেশ্যে মহারাষ্ট্রে গণপতি উৎসব। (১৮৯৩ খ্রিস্টাব্দে) ও শিবাজী উৎসব (১৮৯৫ খ্রিস্টাব্দে) প্রবর্তন | করেন।
  • ১৮৯৬ খ্রিস্টাব্দে মহারাষ্ট্রে ব্যাপক দুর্ভিক্ষ দেখা দিলে সরকারের ঔদাসীন্য নীতির প্রতিবাদে ব্যাপক গণ সচেতনতা গড়ে তোলেন।
  • ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে 'বঙ্গভঙ্গ' বিরোধী আন্দোলনেও অংশগ্রহণ করেন।
  • জনপ্রিয়তার জন্য তিনি 'লোকমান্য' অভিধায় ভূষিত হন।
  • ভ্যালেন্টাইন তাঁকে, 'Father of Indian Unrest' বলেন ও গান্ধীজি বলেন 'Maker of Modern India'.
  • 'স্বরাজ আমার জন্মগত অধিকার এবং এটা অর্জন করবই'-তাঁর এই উদ্ধৃতির জন্য তিনি খ্যাত।
  • স্বদেশি অন্যতম প্রধান নির্মাতা তিনি।
  • হোমরুল লিগ নির্মাণ করেন স্বরাজের উদ্দেশ্যে।
  • 'Gita Rahasya' এবং 'The Arctic Home in the Vedas'-বইয়ের লেখক।
  • ১৯২০ সালে ১ আগস্ট মহাত্মা গান্ধী অসহযোগ আন্দোলন শুরু করেন। সেই দিন তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

লালা লাজপত রাই (১৮৬৫-১৯২৮)

  • পাঞ্জাবের লুধিয়ানায় জন্মগ্রহণ করেন এবং আর্য সমাজ ও শুদ্ধি আন্দোলনে যোগদান করেন।
  • ১৮৮৮ খ্রিস্টাব্দে জাতীয় কংগ্রেসের এলাহাবাদ অধিবেশনে যোগদান করেন।
  • চরমপন্থী মতাদর্শে বিশ্বাসী এই রাজনীতিবিদ মনে করতেন ভিক্ষানীতি বর্জন করে আত্মশক্তি ও আত্মত্যাগের মাধ্যমে দেশবাসী স্বাধীনতা লাভ করবে।"
  • তিনি নিষ্ক্রিয় প্রতিরোধে অর্থাৎ 'স্বদেশি' ও 'বয়কটের' পূর্ণ সমর্থক ছিলেন।
  • স্বরাজ্য দলে তিনি যোগদান করেন।
  • ১৯১৮ খ্রিস্টাব্দে সাইমন কমিশন বয়কট করার আন্দোলনে সামিল হওয়ায় পুলিশের লাঠির আঘাতে প্রাণ হারান।
  • তাঁর রচিত গ্রন্থ 'ইয়ং ইন্ডিয়া', 'ইংল্যান্ড ডেবট টু ইন্ডিয়া', 'দ্য পলিটিক্যাল ফিউচার অব ইন্ডিয়া'।
  • ১৮৮৯ খ্রিস্টাব্দে INC-এর বোম্বে অধিবেশনে দুটি স্বাধীনতা সংগ্রামী নেতা বিপিন চন্দ্র পাল এবং বাল গঙ্গাধরের তিলকের সঙ্গে যুক্ত হন। এই ত্রয়ী 'লাল-বাল-পাল' নামে খ্যাত।
  • বিপিনচন্দ্র পাল এবং লোকমান্য তিলকের সঙ্গে বরাবর স্বদেশী আন্দোলনের পথিকৃৎ ছিলেন।
  • ১৮৯৫ সালে পাঞ্জাব ন্যাশনাল ব্যাঙ্ক গঠনে প্রচেষ্টা করেছিলেন।
  • ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে 'All India Trade Union Congress'-এর প্রথম সভাপতি হয়েছিলেন।
  • 'Servants of People' সোসাইটির প্রতিষ্ঠা করেন তিনি। দেশের স্বাধীনতা আন্দোলন এবং সমাজ সংস্কার আন্দোলনের জন্য কাজ করে এই সংস্থা।

অরবিন্দ ঘোষ (১৮৭২-১৯৫০)

  • বাঙালি চরমপন্থী বিপ্লবী, বরোদা কলেজের অধ্যাপক এবং অনুশীলন সমিতি ও যুগান্তর সমিতি নামক দুই বিপ্লবী গুপ্ত সমিতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
  • ইন্দুপ্রকাশ পত্রিকায় 'New Lamp for the Old' শীর্ষক প্রবন্ধ প্রকাশের মাধ্যমে নরমপন্থী রাজনীতির তীব্র সমালোচনা করেন।
  • 'বন্দেমাতরম্', 'কর্মযোগিনী' ও 'ধর্ম' পত্রিকার সম্পাদনার কাজে যুক্ত হন।
  • ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দে আলিপুর বোমা মামলায় ধৃত হলেও চিত্তরঞ্জন দাশের সহায়তায় মুক্তি পান।
  • চিত্তরঞ্জন দাশ তাঁকে 'স্বদেশপ্রেমের কবি, জাতীয়তাবাদের দার্শনিক ও মানবতার প্রেমিক' বলেছেন।

খান আব্দুল গফফর খান (১৮৯০-১৯৮৮)

  • উপাধি-সীমান্ত গান্ধী, বাদশাহ খান, সারহাদি গান্ধী, ফকেরই-আফগান।
  • 'লাল কোর্তা', 'খোদাই খিদমতগার' নামক বাহিনী গড়ে তোলেন।
  • তিনি অসহযোগ, আইন অমান্য ও ভারত ছাড়ো আন্দোলনে যোগ দেন।
  • তিনি 'পাখতুন' নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করেন। পরে যার নাম হয় দস্ত রোজা।
  • ১৯৮৭ সালে 'ভারতরত্ন' লাভ করেন।

চন্দ্রশেখর আজাদ (১৯০৬-১৯৩১)

  • ইনি ছিলেন স্বশস্ত্র বিপ্লবী এবং 'হিন্দুস্তান সোশ্যাল রিপাবলিক আর্মির' সদস্য।
  • অসহযোগ আন্দোলনের সময় তিনি বন্দি হন এবং কোর্টে বারংবার তাঁর নাম জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি 'আজাদ' কথাটি বলেন। এই থেকে 'আজাদ' উপাধি পান।
  • কাকোরি ষড়যন্ত্র মামলা, দ্বিতীয় লাহোর ষড়যন্ত্র মামলা, লাহোরে স্যান্ডার্সকে হত্যা এবং কেন্দ্রীয় আইন সভায় বোমা নিক্ষেপ-এরকম একাধিক ঘটনার সঙ্গে জড়িত।
  • শপথ করেছিলেন জীবিত থাকাকালীন ব্রিটিশদের ধরা দেবেন না।
  • Hindustan Republican Socialist Association-এর প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন রামপ্রসাদ বিসমিল। তাঁর মৃত্যুর পর তিনিই প্রথম এটি পুনর্গঠন করেন।
  • এলাহাবাদের অ্যালফ্রেড পার্কে পুলিশের হাতে ধরা পড়ার সময় ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দে ২৭ ফেব্রুয়ারি তিনি আত্মহত্যা করেন।

চক্রবর্তী রাজা গোপালাচারী (১৮৭৮-১৯৭২)

  • তামিলনাড়ু নিবাসী রাজনীতিবিদ।
  • তিনি ছিলেন একাধারে উকিল ও স্বাধীনতা সংগ্রামী রাজাজি ও সিআর নামেও তিনি পরিচিত ছিলেন।
  • ভারতের প্রথম ও শেষ গভর্নর ছিলেন তিনি।
  • লবণ আইন ভঙ্গের অপরাধে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়।
  • ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দের নির্বাচনে তিনি মাদ্রাজের মুখ্যমন্ত্রী নির্বাচিত হন।
  • ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের আগস্ট থেকে নভেম্বর পর্যন্ত বাংলার গভর্নর ছিলেন এবং স্বাধীন ভারতের প্রথম ও শেষ গভর্নর জেনারেল।
  • ১৯৫২-১৯৫৪ সাল পর্যন্ত মাদ্রাজে মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন তিনি।
  • ১৯৫৪ সালে ডঃ এস রাধাকৃষ্ণন ও সি ভি রমনের সঙ্গে ভারত রত্ন পুরস্কার গ্রহণ করেন।
  • তিনি ১৯৫৯ সালে রাজা গোপালাচারীর স্বতন্ত্র পার্টি প্রতিষ্ঠা করেন। উল্লেখ্য তিনি গান্ধীজির অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ছিলেন।

চিত্তরঞ্জন দাস (১৮৭০-১৯২৫)

  • পেশাগতভাবে আইনজীবী এবং আলিপুর বোমা মামলায় অরবিন্দ ঘোষের পক্ষে সওয়াল করেন।
  • তিনি ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দে সর্বভারতীয় স্বরাজ পার্টি গঠন করেন।
  • ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দে কলকাতা কর্পোরেশনের প্রথম মেয়র নির্বাচিত হন।
  • তিনি হিন্দু-মুসলিম সমন্বয়ের লক্ষ্যে 'Das formula' তৈরি করেন।
  • 'নারায়ণ' নামক মাসিক বাংলা পত্রিকা এবং 'Forward' নামক একটি পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
  • ১৮৯৫ সালে মালঞ্চ (কবিতা), ১৯০৪ খ্রিস্টাব্দে 'মালা', ১৯১৫ খ্রিস্টাব্দে 'অন্তর্যামী' এবং ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দে 'সাগর সংগীত' নামক গ্রন্থে কাজ করেন।

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.